জয় কিষাণের জয়যাত্রা

কল্যাণ সেনগুপ্ত
লিখেছেন কল্যাণ সেনগুপ্ত পড়ার সময় 7

কল্যাণ সেনগুপ্ত

দেশের মানুষ দেখল যে, দৃঢ় সংঘবদ্ধ শক্তি ও সঠিক নেতৃত্ব কী ধরনের অসাধ্যসাধন করতে পারে। কেউ কি সত্যি সত্যিই ভাবতে পেরেছিল যে, এই কৃষক আন্দোলন শীত-গ্রীষ্ম-ঝড়-জল- রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এবং পালা করে চাষাবাদকে অব্যাহত রেখে বৎসরাধিক কাল ধরে এই লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে! এই অসাধ্য সাধন দেশব্যাপী সংগ্রামী মানুষের মনে এক বিপুল আশার সঞ্চার করেছে। কৃষক চিনেছে তাঁর আত্মশক্তিকে, ঐক্যবদ্ধতার বিপুল ক্ষমতাকে, জেগেছে আত্মমর্যাদাবোধ।

গোটা দেশের কৃষক আন্দোলন এবং কৃষকের দৈনন্দিন প্রতিকূলতা, তাঁদের ওপর নেমে আসা জুলুমের সংবাদ, তথ্য এবং দেশের কৃষিব্যবস্থার হালহকিকত ও কৃষক আন্দোলন সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনাকে একত্রিত করে রোজকার বার্তাঘর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে ‘জয় কিষাণ’ নামের একটি অনলাইন পোর্টাল। কার্যত দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত দেশের কৃষকসমাজ ও কৃষক আন্দোলনের খবরগুলোকে একত্রিত করবে। এই অনলাইন উদ্যোগটি প্রকাশিত হচ্ছে ‘জয় কিষাণ আন্দোলন’-এর তরফে। যদিও আমরা ‘জয় কিষাণ’কে ‘জয় কিষাণ আন্দোলন’-এর মুখপত্র বলতে চাই না। বরং দেশের জল-জমি-জঙ্গল রক্ষা ও কৃষি-সার্বভৌমত্ব অটুট রাখতে যে সংগ্রাম সেই লড়াইয়ের প্রকৃতই কণ্ঠস্বর হয়ে উঠুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। অগ্রযাত্রার শুভলগ্নে আমরা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই এই জয়যাত্রার কথা।

জয় কিষাণ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ যোগেন্দ্র যাদবের উপলব্ধি ছিল যে আমাদের দেশের মূলশক্তি নিহিত আছে কৃষক সমাজ-সহ গ্রামে। ফলে তিনি সঙ্গীসাথীদের নিয়ে কৃষকদের দুরাবস্থা স্বচক্ষে দেখতে ও বুঝতে গ্রামে গ্রামে যাত্রা শুরু করলেন, প্রচুর ঘুরলেন এবং এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন। তারপর থেকে তিনি কৃষক আন্দোলনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কৃষক আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ার কাজেই সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। সেসময় ২০১৭তেই ঘটে যায় মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরের ঘটনা। কৃষক বিক্ষোভ দমন করতে পুলিশ গুলি চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা করে। এই ঘটনাকে ঘিরেই দেশের কৃষক সমাজে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়া এক দুরন্ত গতি পায়। গোটা দেশের ছোট-বড় প্রায় ৩০০ কৃষক সংগঠন মিলে গড়ে ওঠে ‘AIKSCC’ বা ‘অখিল ভারতীয় কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি’। সারা দেশজুড়ে কৃষকদের মধ্যে সারা পরে যায়, প্রচুর বৃহৎ আকারের কৃষক মিছিল সংগঠিত করা হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই কৃষক ঐক্য মঞ্চের একমাত্র না হলেও অন্যতম প্রধান মুখ অবশ্যই যে যোগেন্দ্র যাদব, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

অতঃপর মোদি সরকার জোর জবরদস্তি করে কৃষিবিল সংসদে আনার পরেই সর্বত্র এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এই বিক্ষোভে অগ্রগণ্য ভূমিকা গ্রহণ করে পাঞ্জাবের কৃষক সমাজ। কারণ কৃষিপ্রধান পাঞ্জাবের সুসংহত মান্ডি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তা তুলে দেওয়া হচ্ছিল প্রভূত শক্তিশালী কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতে এই কৃষিবিলের মাধ্যমে। কৃষি সম্পদ নির্ভর পাঞ্জাবি সমাজ এই আন্দোলনকে তাঁদের ধর্ম ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবেই নিয়েছিল। ফলে গোটা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা পাঞ্জাবিরা এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সর্বশক্তি দিয়ে। সে কারণেই প্রশাসনিক বলপ্রয়োগ করে ভেঙে দেবার চেষ্টা থেকে মোদি সরকারকে বিরত থাকতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত কৃষক আন্দোলনের দাবি মেনে কৃষিবিল প্রত্যাহার করা হয়। এই প্রথম মোদিকে মাথা নত করতে হল কোনো এক আন্দোলনের কাছে।

এই অনলাইন উদ্যোগটি প্রকাশিত হচ্ছে ‘জয় কিষাণ আন্দোলন’-এর তরফে। যদিও আমরা ‘জয় কিষাণ’কে ‘জয় কিষাণ আন্দোলন’-এর মুখপত্র বলতে চাই না। বরং দেশের জল-জমি-জঙ্গল রক্ষা ও কৃষি-সার্বভৌমত্ব অটুট রাখতে যে সংগ্রাম সেই লড়াইয়ের প্রকৃতই কণ্ঠস্বর হয়ে উঠুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। অগ্রযাত্রার শুভলগ্নে আমরা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই এই জয়যাত্রার কথা।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এমন সার্থক শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলন মানুষ দেখেনি। এর ফলে দেশের মানুষ দেখল যে, দৃঢ় সংঘবদ্ধ শক্তি ও সঠিক নেতৃত্ব কী ধরনের অসাধ্যসাধন করতে পারে। কেউ কি সত্যি সত্যিই ভাবতে পেরেছিল যে, এই কৃষক আন্দোলন শীত-গ্রীষ্ম-ঝড়-জল- রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এবং পালা করে চাষাবাদকে অব্যাহত রেখে বৎসরাধিক কাল ধরে এই লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে! এই অসাধ্য সাধন দেশব্যাপী সংগ্রামী মানুষের মনে এক বিপুল আশার সঞ্চার করেছে। কৃষক চিনেছে তাঁর আত্মশক্তিকে, ঐক্যবদ্ধতার বিপুল ক্ষমতাকে, জেগেছে আত্মমর্যাদাবোধ। কৃষক ফিরে পেয়েছে তাঁর সামাজিক স্বীকৃতি অন্নদাতারূপে। সমাজের চোখে কৃষিকাজ এখন আর কোনো হীনমন্যতার পেশা নয়, গর্বের। কৃষকদের এই ঐতিহাসিক আন্দোলন দিয়েছে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে জয়ের আস্বাদ।

এই সফল কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল সংযুক্ত কৃষক মোর্চা। এর পূর্ববর্তী পদক্ষেপ ছিল ২০১৭-য় মন্দসৌরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে AIKSCC বা অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি গঠন। সেই সমিতি গঠনের পূর্বে জয় কিষাণ আন্দোলন দেশজুড়ে বহু যাত্রা ও লড়াই, সংগ্রাম চালিয়েছে। স্বরাজ ইন্ডিয়ার উদ্যোগে ‘জয় কিষাণ আন্দোলন’ গঠিত হলেও এটি একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কৃষক স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠন। উক্ত দুটি সংগঠন একে অপরের পরিপূরক হলেও নিয়ন্ত্রক নয়।

সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বে, AIKSCC ‘র উদ্যোগে আয়োজিত পশ্চিমবঙ্গ কৃষক – মজুর মহাপঞ্চায়েতে বক্তব্য রাখছেন গণ-আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী মেধা পাটেকর

২০১৫ সালে মধ্য ভারতের এক বড় অংশে জয় কিষাণ আন্দোলনের নেতৃত্ব কৃষকদের দুরাবস্থা জানতে যাত্রা করেন খরা অধ্যুষিত অঞ্চলে ‘সংবেদন যাত্রা’ নামে। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাঁদেরকে কৃষক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আরও বেশি নিশ্চিত ও দৃঢ় করে। তাঁরা সেসময় দেখেছেন খাদ্যের অভাবে মানুষতো কষ্ট পাচ্ছেনই, রাস্তাঘাটে যত্রতত্র গবাদি পশুর মৃতদেহ পরে আছে, পরিস্থিতি কতখানি ভয়াবহ, তার সাক্ষীরূপে। তাঁরা তখন শুধু যাত্রার মাধ্যমে সমস্যাগুলো জেনেই ক্ষান্ত হননি, সেই সমস্যার সমাধানে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দরবার করেন এবং আইনানুগ রিলিফ আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। সেই খরার সময়ে কৃষক অধিকারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াই চালাতে হয় প্রশান্ত ভূষণের মাধ্যমে। এরই কিছুকাল পূর্বে, ২০১৫তেই ভূমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে অন্যত্র সংগঠিত করেন ‘ট্রাক্টর যাত্রা’। এরপর ২০১৬ সালে মহারাষ্ট্র ও বুন্দেলখন্ডে ‘জল-হল পদযাত্রা’ সংগঠিত করা হয়। ২০১৭ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘কিষাণ মুক্তি যাত্রা’র আয়োজন করা হয় এবং যাত্রার অন্তে দিল্লির যন্তরমন্তরে ‘কিষান মুক্তি জনসভা’য় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রচুর কৃষক যোগদান করেন। সুতরাং দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্বের শেষেই কৃষক আন্দোলন দানা বাঁধে, যারই ফলশ্রুতিতে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন এই সফলতা পায় এবং এর পেছনে জয় কিষাণ আন্দোলনের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল।

জয় কিষাণ আন্দোলনের তরফে প্রকাশিত ‘জয় কিষাণ’-এ দেশের কৃষিজীবী মানুষের কন্ঠ প্রতিধ্বনিত হোক এবং সেই কন্ঠের কোরাসে মিলে যাক হে পাঠক আপনারও স্বর, এই প্রত্যাশাও রেখে গেলাম।

জল-জমি-জঙ্গল রক্ষার লড়াই পৌঁছে যাক সাম্য, সমানাধিকার ও ন্যায়বিচারপূর্ণ দেশ গড়ার বৃহৎ লক্ষ্যে।

কৃষিজীবী মানুষের জয় হোক।

শুভকামনা।

সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বে, AIKSCC ‘র উদ্যোগে আয়োজিত পশ্চিমবঙ্গ কৃষক – মজুর মহাপঞ্চায়েত
ছবি- অত্রি ভট্টাচার্য

কল্যাণ সেনগুপ্ত

রাজ্য সহ সভাপতি, জয় কিষাণ আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
মতামত দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *