” …মোর্চার ৩৮৩ দিন ব্যাপী দিল্লির সিংঘু বর্ডারে সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনে কৃষক ক্ষেতমজুরদের সংহতি জানাতে এগিয়ে এসেছিলেন সংগঠিত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা, ছাত্র-যুব সম্প্রদায়, মধ্যবিত্ত সমাজ-সহ গণতন্ত্র প্রিয় বিভিন্ন স্তরের মানুষ … ” লিখছেন অতনু সিংহ
কৃষকের দাবিদাওয়াকে সামনে রেখে কৃষক আন্দোলন জারি থাকলেও শনিবার গোটা দেশে রাজভবন অভিযান থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠল। দেশের সাংবিধানিক চরিত্রকে ধ্বংস করে যেভাবে একটি একমাত্রিক হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি জাতিরাষ্ট্র কায়েম করার চেষ্টা চলাচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদী আরএসএস-এর নিয়ন্ত্রনাধীন বিজেপির নেতৃত্বে চলা কেন্দ্রীয় সরকার, যেভাবে দেশের মেহনতি মানুষের জীবন-জীবিকা-রুটি-রুজির ওপর হামলা চালানো হচ্ছে, যেভাবে দেশের বিচার ব্যবস্থা, সংবাদ মাধ্যম এবং শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-সহ সকল প্রকার স্বাধীন কন্ঠস্বরকে রোধ করার চেষ্টা চলছে আর তারই মুখোমুখি কেন্দ্রীয় ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে গোটা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রান্তে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন সমূহ যেভাবে বৃহত্তর এক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেহারা নিতে চাইছে সেই বৃহত্তর আন্দোলনের আগামী দিনের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে চলেছে কৃষিজীবী মানুষের নেতৃত্বে চলা এই গণ-আন্দোলন। ইতিপূর্বেই আমরা দেখেছি এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের পিঠোপিঠি কৃষকদের দাবি দেওয়া কে ভিত্তি করে উত্থান হয়েছিল সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। আর মোর্চার ৩৮৩ দিন ব্যাপী দিল্লির সিংঘু বর্ডারে সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনে কৃষক ক্ষেতমজুরদের সংহতি জানাতে এগিয়ে এসেছিলেন সংগঠিত-অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা, ছাত্র-যুব সম্প্রদায়, মধ্যবিত্ত সমাজ-সহ গণতন্ত্রপ্রিয় বিভিন্ন স্তরের মানুষ। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও কৃষকের হকের পক্ষে সেদিন আওয়াজ তুলেছিলেন। ফলত, শুরু থেকেই এই কৃষক আন্দোলন শুধুমাত্র কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের দাবিদাওয়া ভিত্তিক আন্দোলন নয় বরং মোদি সরকারের বিরুদ্ধে এবং সমানাধিকার সমন্বয় সহাবস্থান এবং বৈচিত্র্যের পক্ষে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই একটি সবুজ দিশা যা দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ও ভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
শনিবার ‘রাজভবন অভিযান’ কর্মসূচি থেকে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা দ্বিতীয় পর্যায়ের যে আন্দোলন শুরু করল তার বাহ্যিক দিক মোদি সরকারের কাছ থেকে বকেয়া দাবিগুলো আদায় করা এবং প্রতিটি রাজ্যের তৃনমূলস্তর থেকে কৃষকদের হক রাষ্ট্রীয় পর্যায় অবধি সুপ্রতিষ্ঠিত করা। কিষাণ মোর্চার দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনের এই যে বাহ্যিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য তা দেখে অনেকের মনে হতে পারে যে মোদি-শাহ সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলো সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার দাবিগুলো মেনে নিলেই যেন বা আন্দোলন চিরতরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে এবং মোর্চার অবলুপ্তি ঘটবে। কিন্তু সত্যিই এমন কেউ যদি মনে করেন তবে তার এই মনে হওয়াটা নিছকই অপরিণামদর্শিতার উদাহরণ হবে। কেননা মোর্চার দাবিদাওয়াগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে এই দাবিদাওয়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে দেশের চলমান লুঠতরাজ ব্যবস্থার বিপরীতে দেশের গণমানুষের মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধানের রূপরেখা যা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম করার অনন্য একটি আহ্বানও বটে।
মনে রাখতে হবে উপনিবেশপূর্ব ও ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ এবং আজকের আধুনিক ভারত ইউনিয়ন মূলত কৃষিনিবিড় এবং কৃষিবান্ধব পারম্পরিক কারিগরি ব্যবস্থার একটি বৃহৎ ক্ষেত্র আর তাই ভারতের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি খুব বেশি করেই ভূমিকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। অতএব কৃষক, ক্ষেতমজুর ও কারিগরদের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান হলে বর্ণাশ্রমপন্থী ও কর্পোরেট পুঁজির তল্পিবাহকদের রাজনীতি অচল হয়ে পড়বে। সে কারণে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই কখনো পশ্চিমা সামাজ্যবাদীদের দ্বারা অথবা কখনো পশ্চিমা ঔপনিবেশিকদের বন্ধুদের দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছে কৃষক, ক্ষেতমজুর, মৎস্যজীবী, মাঝিমাল্লারা ও কারিগরেরা। এর বিরুদ্ধে নানা সময় নানা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃষিজীবীদের হাতে থাকেনি বরং ইউরোপের ইতিহাস ও উৎপাদন ব্যবস্থার অনুকরণে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও উৎপাদন ব্যবস্থার পর্যালোচনা করা হয়েছে, ইউরোপীয় পুঁজির ধারাবাহিকতা ও তাঁকে কেন্দ্র করে যে আধুনিক রাজনীতির বিবর্তন ঘটেছে সেই রাজনীতিকেই একভাবে এখানকার গণমানুষের রাজনীতি হিসেবে কল্পনা করতে চেয়েছেন অনেকেই। এর ফলে ভারতের ভূমিনিবিড় মানুষের সঙ্গে সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার। আর তার সুযোগেই নিপীড়ক ব্রাহ্মণ্যবাদী তথা ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র তত্ত্বের কর্পোরেট তল্পিবাহক অনুসারীরা খুব সহজেই ঔপনিবেশিক প্রভুদের বদলে নিজেরাই হয়ে উঠেছে দেশীয় লুঠেরা।
নানাসময়ে এই ঔপনিবেশিক, জাতিরাষ্ট্রবাদী রাজনীতির মুখোমুখি কৃষিজীবী মানুষের নেতৃত্বে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মতো করে বড়সড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হলেও কৃষকদের হাত থেকে ব্যাটন ফস্কে যাওয়ায় শেষমেশ সেই সকল বিপ্লবের তরী তীরে আসার আগেই জলে ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু আজকের এই অধুনান্তিক ভারতে একদিকে যখন সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদ বড়সর দৈত্যের আকার নিয়ে মানুষের কাছে হাজির হচ্ছে তখনই সেই দৈত্যকে প্রাণান্তকরনে মোকাবিলার জন্য সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন দেশের অন্নদাতারাই। তাঁরা একদিকে যেমন তাঁদের দাবি দাওয়াগুলো পূরণ করতে চাইছেন ঠিক তেমনই তাঁদের সাফ কথা ভারতের গণতন্ত্র ও সামগ্রিক বৈচিত্র্যের পুনরুত্থান না হলে কৃষকদের অধিকার কখনই সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না তাই রাজভবন অভিযানের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের যে আন্দোলন শুরু করেছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা তার স্লোগান থেকে বয়ান, তার দৃঢ়তা থেকে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ভঙ্গিমা সবেতেই ফুটে উঠছে ফ্যাসিবাদ-মুক্ত ভারতের স্বর্ণালী ভবিষ্যৎ গঠনের দৃঢ় অঙ্গীকার। গোটা দেশে শনিবার থেকে শুরু হওয়া কৃষকদের দ্বিতীয় পর্যায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে চোখ রাখলে ও কান পাতলে এ কথা স্পষ্টভাবে যে কেউ বুঝতে পারবেন। যদি তিনি কোনো প্রকার কর্পোরেট হ্যাংওভারে না থাকেন কিম্বা কোনোপ্রকার ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিরাষ্ট্রের আফিমে বুঁদ হয়ে না থাকেন।
