কৃষক আন্দোলন নিয়ে এবার ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো

অরূপশঙ্কর মৈত্র
লিখেছেন অরূপশঙ্কর মৈত্র পড়ার সময় 14

অরূপশঙ্কর মৈত্র

সরকারিভাবে মানুষের কল্যাণে সাইলোতে দীর্ঘদিনের জন্য খাদ্যশস্যের মজুত করার ব্যবস্থা। উৎপন্ন ফসলকে দীর্ঘদিন মজুত করে রাখার জন্য, সেই সাইলো এখন বেসরকারি ক্ষেত্রেও তৈরি হতে শুরু করেছে। একা আদানিই প্রায় সারা দেশ জুড়ে হেক্টর হেক্টর জমি জুড়ে অজস্র সাইলো তৈরি করেছে। আদানির সেই সাইলো নিয়ে খবর করতে গিয়ে এক সাংবাদিক সাংঘাতিক বিপদের মুখে পড়েছিলেন। ইতিমধ্যেই কর্পোরেট পুঁজির রাশ, ট্রাডিশনাল টাটা-বিড়লাদের হাত থেকে চলে এসেছে ক্রোনি ক্যাপিট্যালের নায়কদের হাতে। একটি ক্ষুদ্র গুজরাটি ওলিগার্কি তৈরি হয়ে গেছে। অনেকেই সন্দেহ করেছেন, চাষের ফসলের এই বাজার অর্থনীতির আওতায় আনার চেষ্টা আদপেই ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিদের স্বার্থে নয়, ওই ক্রোনি, ওলিগার্ক বৃহৎ পুঁজির জন্য কৃষির বিশাল বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়াই লক্ষ্য।

ফার্মারস মুভমেন্ট। দুটো ইংরেজি শব্দ মিলে একটা সারকাজম। গত দু’বছরে ফার্মা শব্দটা বারবার আমাদের কানে এসেছে। ফার্মা অর্থাৎ ওষুধ কোম্পানি। ফাইজার, মডার্না, সিরাম ইন্সটিটিউট, বায়োএন্টেক। এক এক একটা বিশাল বিশাল কর্পোরেট ফার্মা কোম্পানি। তারা মারাত্মক মারণ অসুখ কোভিডের অতিমারি থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য কীভাবে অক্লান্ত যুদ্ধ করে গেছে, আজও করে চলেছে তা আমরা মিডিয়া থেকে সবিস্তারে জানতে পেরেছি।

দ্বিতীয়টা ফার্মা নয়, ফার্মার। ফার্ম থেকে ফার্মার। ফার্মা কোম্পানি ওষুধ তৈরি করে, ফার্মারও তৈরি করে খুব প্রয়োজনীয় বস্তু, ওষুধের মতোই। খাদ্য। অসুখ নয়, সুখের জন্য। আমাদের ক্ষুধা নিবারণ শুধু নয়, আমাদের তৃপ্তিরও জন্ম ওই ফার্মারদের হাতে। জিহ্বার স্বাদ, রস তৈরি করে। টক, ঝাল, নুন, মিষ্টি। সেই ফার্মারদের মুভমেন্ট। কৃষক। কৃষক আন্দোলন। সেও চলল প্রায় একবছর। সেই আন্দোলন নাকি কৃষিকে কর্পোরেট হাঙ্গরদের গ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য। প্যানডেমিকে যখন বিশ্ব থরহরি কম্পমান, মাস্ক ছাড়া, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংকে পাত্তা না দিয়ে প্রায় একবছর আবালবৃদ্ধবনিতার অবস্থান চলল, প্রায় ৬০০ জনের মৃত্য হল, সারা বিশ্বজুড়ে হৈ হৈ ফেলে দিল। মিডিয়া’র ভূমিকা ওই ফার্মা মুভমেন্টের ঠিক বিপরীত। কার্যত মেইন্সট্রিম মিডিয়া এই ফার্মারস মুভমেন্ট বয়কট করেছিল। ফার্মার আন্দোলনকারীরা মিডিয়ার নতুন নামকরণ করল, গোদি মিডিয়া। নামটা আজ বিপূল জনপ্রিয়। মিডিয়ার কথায়, খবরে যারা মতামত তৈরি করে তাদের নতুন নাম হয়েছে ‘গদ’। ‘গদ’ মানে ‘বিষ’, ‘গদ’ মানে ‘রোগ’। গোদি মিডিয়া।  

একটা আদ্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের চাপে নরেন্দ্র মোদিজির সরকার ফার্মা বিল স্থগিত করে দিল! এতটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ? দ্বিতীয় রহস্য, এই আন্দোলন কেন শুধু উত্তরভারতেই সীমাবদ্ধ রইল? কেন বাংলা, আসাম, ওড়িশা, অন্ধ্র, দক্ষিণ ভারতেও শুরু হল না? প্রথমে এই দ্বিতীয় রহস্য নাড়াচাড়া করা যাক। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই আন্দোলন ছিল, মূলত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উওরাখণ্ড, ইউপির পশ্চিম অংশের মধ্যে আটকে। কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দিল্লি’র জন্য এমনটা মনে হতে পারে। কিন্তু দেশের বাকি অংশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি কেন? কিছু কিছু নিয়মরক্ষা সমর্থন, মিছিল, সভা ইত্যাদি ছাড়া কিছুই হয়নি। কেন?

প্রায় টানা একবছর এই ফার্মারস মুভমেন্ট বা কৃষক আন্দোলন চলল। এমন দীর্ঘস্থায়ী অথচ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অনেকদিন দেখা যায়নি। মোদি সরকারের নতুন কৃষিবিলের প্রতিবাদেই এই আন্দোলন। কী ছিল সেই কৃষি বিলে? এতদিন ধরে কৃষকের ফসল বিক্রি করার জায়গা ছিল মান্ডি। সরকার নিয়ন্ত্রিত এই মান্ডিতে চাষিরা তাঁদের ফসল বিক্রি করবে, কেননা তাঁদের যেন বাইরের ধূর্ত বড় ব্যবসায়ীদের পাতা ফাঁদে পড়তে না হয়। নিয়ম মতো এই মান্ডির একটা নির্দিষ্ট এলাকা আছে আর তা সেই সেই রাজ্যের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। উৎপন্ন ফসল রাজ্যের বাইরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা যাবে না। অথবা বাইরে থেকে আমদানি করা ফসলের ওপর রাজ্যের অধিকার থাকবে কর আদায়ের। সেটা তুলে দেওয়া হল। সরকার বলতে চাইল, এটা কৃষকদের স্বার্থেই করা হল। বিশেষ করে ছোট মাঝারি চাষিদের জন্য। এই প্রান্তিক ক্ষুদ্র মাঝারি চাষি আমাদের দেশে প্রায় ৮৬%। নতুন বিলে বলা হল, চাষিরা এখন থেকে তাদের ফসল মান্ডি ছাড়াও যে কাউকে বিক্রি করতে পারবে। রাজ্য ছাড়িয়ে যেকোনোও জায়গায় গিয়ে বিক্রি করতে পারবে। কিংবা ক্ষেত থেকে ফসল তুলে গোলায় তোলার আগে, ওই ক্ষেতের আলের ওপর বসেই খদ্দেরের সঙ্গে দরাদরি করে বিক্রি করে দিতে পারবে। কষ্ট করে গাড়ি জোগাড় করে দূরে মান্ডি হাউসে নিয়ে গিয়ে সকাল থেকে লাইন দিয়ে বিক্রি করার হ্যাপা পোয়াতে হবে না। চাষি এর ফলে পরিবহন খরচ বাঁচাতে পারবে। তাছাড়াও বাজারে সে যদি বেশি দর পায়, সেটাও তার পক্ষে মঙ্গল। গোদা বাংলায়, কৃষিক্ষেত্রেও ‘মহান বাজার অর্থনীতি’ চালু হয়ে গেল। এক দেশ, এক বাজার। এই বাজার অর্থনীতির সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক পটভূমি তৈরির কাজ বেশ কিছুকাল হল শুরু হয়ে গেছে। এক দেশ-এক জাতি-এক ভাষা-এক ধর্ম-এক নেতা। “এক দেশ-এক বাজার” হল কর্পোরেট পুঁজির দীর্ঘদিনের কর্মসূচি। এর বাস্তবায়িত করার ইতিহাসও অনেক পুরোনো। এর জন্যেই স্বাধীনতার আগে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব নেহেরু ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বল্লভভাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। পরে মাউন্টব্যাটেন যখন সারাদেশে ১৩টি পৃথক পৃথক স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা পড়ে নেহেরু রেগে গিয়ে বলেছিলেন এ তো বলকানাইজেশন। বলকানাইজেশন ভালো না মন্দ, বিচার আমরা করি না। ওই বিলিতি সাহেবরা যা বলে, বলকানাইজেশন নাকি খারাপ। শেষকালে ভিপি মেনন এসে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্রের প্রস্তাব দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। শরৎ বোস, আবুল হাসিমদের স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব শুনেই বল্লভভাই প্যাটেল তার করে মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়ে দেন, এক্ষুনি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এক্ষুনি করলে আমরা ডোমিনিয়ন স্টেটাস মেনে নেব। ভারত কমনওয়েলথে বরাবর থেকে যাবে। (আজও ইন্ডিয়া কমনওয়েলথের সদস্য।) কলকাতার মারোয়াড়ি সোসাইটিও সঙ্গে সঙ্গে তার করে জানিয়েছিল, দেরি না করে এক্ষুনি বাংলা ভেঙ্গে দু’টুকরো করে ফেলতে হবে, নইলে মারাত্মক দাঙ্গা অনিবার্য। আজ প্যাটেলজির বিশাল মূর্তি প্রতিষ্টা হয়ে গেছে। বাংলা ভাগ হয়ে আজ ভিখারি।

এতকিছু সত্ত্বেও পরে ‘স্বাধীন’ ভারতের সংবিধানে বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতার একটা রূপরেখা তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। কৃষি এবং শিক্ষা সম্পূর্ণ রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত ছিল। ফলে কৃষি’র বাজার সারাদেশ জুড়ে মুক্ত ছিল না। সেই নিয়ে তেমন অশান্তিও এতদিন হয়নি, কারণ, কর্পোরেট পুঁজি কৃষিকেন্দ্রিক যন্ত্রপাতি, সেচের জন্য খাল, বাঁধ নিয়ে ব্যবসা করলেও সরাসরি ফসলের ব্যবসায় উৎসাহী ছিল না। তখন কর্পোরেট পুঁজির নেতৃত্বে ছিল টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা, আগরওয়াল প্রমুখেরা। প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। সমগ্র মধ্যভারত জুড়ে বিপুল খনিজ পদার্থের ওপর শকুনের দৃষ্টি আজও। এই অঞ্চলগুলো ছিল মূলত এদেশের আদি বাসিন্দাদের। তাঁরা প্রকৃতির শত্রু নয়, প্রকৃতির অংশ ছিলেন। তাই জলজঙ্গল রক্ষা করা সামাজিক দায়িত্ব মনে করতেন। চাষ, ফলমূল সংগ্রহ আর শিকার ছিল তাঁদের খাদ্যের উৎস। ৭৫ বছরের অমৃত মহোৎসবে জানা গেল, খনিজ পদার্থের দখল আর বাঁধ নামের এক দৈত্য রচনার সাইড এফেক্টে প্রায় ৯ কোটি আদিবাসী আজ বাস্তুচ্যুত। অপুষ্টি, শিশুমৃত্যুর হারে তাদের অবস্থা শুনলে মনে হবে, এরচেয়ে সহজে আমেরিকায় যেভাবে আদিবাসীদের গণহত্যা করে জলজমি দখল করা হয়েছিল, সেটা অনেক মানবিক ছিল। চাষের ফসল চাষি নিজে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, উদ্বৃত্ত বাজারজাত করত। এই বিক্রিবাটা নিয়ে চাষিদের উপকার আর বাকি জনতার সুবিধের জন্য, ১৯৬৪ সালে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার জন্ম হল। ফুড কর্পোরেশন নানা জায়গায় এই উদ্বৃত্ত ফসল সারা দেশে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিল।

“এক দেশ-এক বাজার” হল কর্পোরেট পুঁজির দীর্ঘদিনের কর্মসূচি। এর বাস্তবায়িত করার ইতিহাসও অনেক পুরোনো। এর জন্যেই স্বাধীনতার আগে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব নেহেরু ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বল্লভভাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। পরে মাউন্টব্যাটেন যখন সারাদেশে ১৩টি পৃথক পৃথক স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা পড়ে নেহেরু রেগে গিয়ে বলেছিলেন এ তো বলকানাইজেশন। বলকানাইজেশন ভালো না মন্দ, বিচার আমরা করি না। ওই বিলিতি সাহেবরা যা বলে, বলকানাইজেশন নাকি খারাপ। শেষকালে ভিপি মেনন এসে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্রের প্রস্তাব দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। শরৎ বোস, আবুল হাসিমদের স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব শুনেই বল্লভভাই প্যাটেল তার করে মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়ে দেন, এক্ষুনি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এক্ষুনি করলে আমরা ডোমিনিয়ন স্টেটাস মেনে নেব। ভারত কমনওয়েলথে বরাবর থেকে যাবে। (আজও ইন্ডিয়া কমনওয়েলথের সদস্য।)

একসময় ফসল দীর্ঘদিনের জন্য মজুত করার উদ্দেশ্যে ইন্দিরা গান্ধি সাইলো তৈরি করতে শুরু করলেন। সাইলোতে ফসল বৈজ্ঞানিক উপায়ে অনেকদিন মজুত করে রাখা যায়। আজ সত্যিই দেশে মজুত ফসলের পরিমাণ যথেষ্ট। যদিও তাতে প্রান্তিক মানুষের অপুষ্টি কমছে না। অনাহারে মৃত্যুও প্রায় স্বাভাবিক। তবু সরকারিভাবে মানুষের কল্যাণে সাইলোতে দীর্ঘদিনের জন্য খাদ্যশস্যের মজুত করার ব্যবস্থা। উৎপন্ন ফসলকে দীর্ঘদিন মজুত করে রাখার জন্য, সেই সাইলো এখন বেসরকারি ক্ষেত্রেও তৈরি হতে শুরু করেছে। একা আদানিই প্রায় সারা দেশ জুড়ে হেক্টর হেক্টর জমি জুড়ে অজস্র সাইলো তৈরি করেছে। আদানির সেই সাইলো নিয়ে খবর করতে গিয়ে এক সাংবাদিক সাংঘাতিক বিপদের মুখে পড়েছিলেন। ইতিমধ্যেই কর্পোরেট পুঁজির রাশ, ট্রাডিশনাল টাটা-বিড়লাদের হাত থেকে চলে এসেছে ক্রোনি ক্যাপিট্যালের নায়কদের হাতে। একটি ক্ষুদ্র গুজরাটি ওলিগার্কি তৈরি হয়ে গেছে। অনেকেই সন্দেহ করেছেন, চাষের ফসলের এই বাজার অর্থনীতির আওতায় আনার চেষ্টা আদপেই ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিদের স্বার্থে নয়, ওই ক্রোনি, ওলিগার্ক বৃহৎ পুঁজির জন্য কৃষির বিশাল বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়াই লক্ষ্য।

‘স্বাধীন’ ভারতের সংবিধানে বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতার একটা রূপরেখা তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। কৃষি এবং শিক্ষা সম্পূর্ণ রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত ছিল। ফলে কৃষি’র বাজার সারাদেশ জুড়ে মুক্ত ছিল না। সেই নিয়ে তেমন অশান্তিও এতদিন হয়নি, কারণ, কর্পোরেট পুঁজি কৃষিকেন্দ্রিক যন্ত্রপাতি, সেচের জন্য খাল, বাঁধ নিয়ে ব্যবসা করলেও সরাসরি ফসলের ব্যবসায় উৎসাহী ছিল না। তখন কর্পোরেট পুঁজির নেতৃত্বে ছিল টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা, আগরওয়াল প্রমুখেরা। প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। সমগ্র মধ্যভারত জুড়ে বিপুল খনিজ পদার্থের ওপর শকুনের দৃষ্টি আজও।

চাষিদের মনে আশঙ্কা এল, তাহলে এতদিনের প্রচলিত মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এমএসপি) বা ফসলের ন্যূনতম মূল্যের যে নিশ্চিন্তি ছিল তা কার্যত বাতিল হয়ে যাবে। বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটবে সাহায্যের অজুহাতে। চাষির নিজের মত করে চাষ করার ওপর দখলদারি চাপিয়ে দেবে।

শুরু হল স্বাধীন ভারতে কৃষকদের বৃহত্তম আন্দোলন। শেষে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিবিল স্থগিত করে দেওয়ায় আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত হল। কৃষকদের দাবি এমএসপি কিন্তু সরকার আজও মানেনি। অর্থাৎ মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের নিচে ফসলের কেনাবেচা নিষিদ্ধ হয়নি। কাজেই আদানিজির সাইলোগুলো আছে, থাকবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। দুটো প্রাসঙ্গিক রহস্য আছে। একটা আদ্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের চাপে নরেন্দ্র মোদিজির সরকার ফার্মা বিল স্থগিত করে দিল! এতটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ? দ্বিতীয় রহস্য, এই আন্দোলন কেন শুধু উত্তরভারতেই সীমাবদ্ধ রইল? কেন বাংলা, আসাম, ওড়িশা, অন্ধ্র, দক্ষিণ ভারতেও শুরু হল না? প্রথমে এই দ্বিতীয় রহস্য নাড়াচাড়া করা যাক। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই আন্দোলন ছিল, মূলত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উওরাখণ্ড, ইউপির পশ্চিম অংশের মধ্যে আটকে। কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দিল্লি’র জন্য এমনটা মনে হতে পারে। কিন্তু দেশের বাকি অংশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি কেন? কিছু কিছু নিয়মরক্ষা সমর্থন, মিছিল, সভা ইত্যাদি ছাড়া কিছুই হয়নি। কেন?

ঠিক এইখানেই এদেশের দুর্ভাগ্যের রহস্য লুকিয়ে আছে। পৃথিবীর আদিম কৃষিব্যবস্থা শুরু হয়েছিল আজকের ইরান আফগানিস্তানের সংযোগস্থলে। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ কৃষি সভ্যতার জন্ম সিন্ধু সভ্যতায়। মোটামুটি হাজার দশ-বারো বছর আগে কৃষির বিকাশ শুরু। ততদিনে বরফযুগ শেষ। এদেশে কৃষির বিস্তার সিন্ধু সভ্যতা শেষ হবার অনেক পরে ধীরে ধীরে গঙ্গা উপত্যকায়, দক্ষিণের নানা নদী উপত্যকায়। বাংলায় উপত্যকা ছিল না, ছিল অববাহিকা। বাংলা ছিল প্রকৃতির এক বিচিত্র কুমোরটুলি। একের পর এক চর নির্মিত হয়, আবার জলে বিসর্জন। চর গজায় আবার ভেঙে জলে মিশে যায়। তাই নদীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাষবাসও তার বাসস্থান বদলে বদলে গেছে, সঙ্গে তার চরিত্রও। ইটন নামে এক সাহেবের তত্ত্ব হল, বাংলায় কৃষির বিস্তার পীর ফকিরদের নেতৃত্বে জঙ্গল অভিযান করে। এই মত বিতর্কিত। এখানে সে নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছি। মূল প্রশ্নে ফিরে যাই। যে কৃষক আন্দোলনকে জিপগাড়ি দিয়ে পিষে মেরে ফেলা গেল না, নানা কায়দায় পুলিশ দিয়েও আটকে দেওয়া গেল না, মিডিয়া যেখানে গোদি উপাধিতে ভূষিত হল, যে লড়াই, সেই আন্দোলন কেন ওই নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে এসে পৌঁছল না? কেন?

এককালের কৃষক নেতা জাঠ বংশোদ্ভূত চৌধুরী চরণ সিং একটা কথা বলেছিলেন, এদেশের দুর্ভাগ্য, কখনও কোনও কৃষক আন্দোলন বা বিদ্রোহ সারা দেশ জুড়ে হয়নি, বা ছড়িয়ে পরেনি। সবই আঞ্চলিক। এমনকি ব্রিটিশ ক্ষমতায় আসার পর বাংলায় যত কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে, শবর, ফকির, সন্ন্যাসী, পাবনা, তিতুমির, বা চোয়াড়, সবই আঞ্চলিক ছিল। কেন?

দীর্ঘ একবছরের কৃষক আন্দোলন দুটি গুরুতর প্রশ্ন রচনা করে গেল। প্রথমত এত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সামনে কিছুটা হলেও মাথা নত হল, কার্যত এক অথারিটেরিয়ান সরকারের! আশ্চর্য! আর, আন্দোলনে সারা দেশের পূর্ণ আন্তরিক সমর্থন সত্ত্বেও তা আঞ্চলিক স্তরেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল!

ভাবো হে, ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।

অরূপশঙ্কর মৈত্র

নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। এক সময়ের সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। পশ্চিমবঙ্গের জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে সুশীল সমাজের যেকয়েকজন প্রতিনিধি সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন অরূপশঙ্কর মৈত্র তাঁদের মধ্যে একজন।

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *