কৃষিক্ষেত্র ও জলবায়ু পরিবর্তনের উপর পুঁজিবাদের প্রভাব

স্নেহা নন্দী
লিখেছেন স্নেহা নন্দী পড়ার সময় 4

সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে মৃত্যু, ধ্বংস, বঞ্চনার শিকার হয়েছে বিশ্বের সাধারন মানুষ। পুঁজিবাদের চূড়ান্ত উথ্বানকে অনেক রিপোর্ট দায়ী করেছে এই মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে। সম্প্রতিকালের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ভারতবর্ষ গত এক বছরে আগের তুলনায় অনেক বেশী বন্যা, ঊষ্ণায়ন, নিম্নচাপ ও খরার সম্মুখীন হয়েছে।

অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০১০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী পরিবেশ বিপর্যয়ের জেরে মারা গেছেন প্রায় ৬.৮ লক্ষ্য মানুষ। মূলস্রোতের মিডিয়ার খবর থেকে প্রায় বঞ্চিত হয়েছে এইসব মানুষের কথা।

মার্কসিস্ট পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধানতম কারন হল চূড়ান্ত পরিমানের অস্থায়ী শিল্প ও কারখানার উত্থান যার জেরে একের পর এক ব্যপক হারে জঙ্গল উচ্ছেদের কাজ চলেছে বিগত কয়েক বছর ধরে। শহর ও শহরতলি জুড়ে ব্যাপক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেটের আধিপত্যকেই কারণ হিসেবে মনে করেছে মার্কসবাদীরা। যদিও সমগ্র দেশ জুড়েই বিভিন্ন রাজ্যে পরিবেশ বান্ধব আইন গড়ে তোলা হয়েছে পরিবেশকে বাঁচানোর হাত থেকে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, পুঁজিবাদী সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে এই আইনের কার্যকরিতা সম্পর্কে।
মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলি এখনও পর্যন্ত পুঁজিবাদের প্রভাবে জলবায়ু বিপর্যয়ের হাত থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচানোর কোনও প্রতিকার বের করতে পারেনি।

কেন্দ্রীয় সরকার এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্টের আওতায় একটি আইন অনেকদিন ধরেই পাশ করানোর চেষ্টা করছে, এই আইনের খসরাটিতে পুঁজিপতিদের অবাধ স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে যা পরিবেশ দূষণ আরও বাড়িয়ে তুলবে।

আইনটি চালু করার প্রসঙ্গে কেন্দ্র কোনও রকম কোনও জনমত নেয়নি বলে জানা গেছে। এই ধরনের প্রজেক্ট নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে উচ্চ আমলাতন্ত্রের বৈঠকে, কিন্তু এই উচ্চ আমলাতন্ত্রকে অনায়াসেই নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে পুঁজিপতিরা। এর নজির হিসেবে ভোপাল গ্যাস কান্ডকে মনে করা যেতে পারে, যেখানে দায়ী ছিল আমেরিকার একটি রাসায়নিক কোম্পানি- ‘ইউনিয়ন কারবাইড করপোরেশন’ সহ ভারতীয় পুঁজিপতিরা।

বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে মৃত্যু হয় হাজার হাজার মানুষের। ভোপাল বিপর্যয় প্রভাব ফেলে মধ্যপ্রদেশের কৃষি ও সেচ কার্যের উপরেও।

ভোপাল ঘটনার পর কংগ্রেস সরকার ১৯৬৮ সালে পরিবেশ রক্ষা আইন চালু করলেও এই আইনের প্রচুর ফাঁক থেকে গেছে যা বর্তমান সময়ে পুঁজিপতিরা ব্যবহার করছে কেবল ব্যক্তিগত মুনাফার স্বার্থে। ভোপালের কারখানার মতন বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার পুঁজিপতিদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এর ফলে পুঁজিপতিরা ব্যক্তিগত মুনাফার স্বার্থে অস্থায়ী শিল্প কারখানা গড়ে তুলছে যা পরিবেশেকে দূষিত করছে ব্যপক হারে।

কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ নদী ও জলাশয়ে ফেলার ফলে তা পরিবেশ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। পরিবেশের এই দূষণের কারনে আমুল পরিবর্তন দেখা গেছে গত কয়েক বছরের জলবায়ুতে।

অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, ধ্বস, খরা, বিশ্ব ঊষ্ণায়ন ক্ষতিগ্রস্ত করছে কৃষিকাজ। জলবায়ুর এই পরিবর্তন কৃষি ও কৃষিজ অর্থনীতির উপর ব্যপক প্রভাব ফেলেছে গত কয়েক বছরে।অতিরক্ত বৃষ্টিপাতের জন্য এই বছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারতবর্ষের চাষীরা। উত্তরাখন্ডের যোশিমঠের অবস্থা পুঁজিবাদের একটি স্বার্থক উদাহরন, যেখানে পাহাড়ের ধাপে অবৈজ্ঞানিক ভাবে হোটেল ও লজ গড়ে তোলা হয়েছে, ফলে ফাটল ধরেছে যোশীমঠে এবং সংকটজনক অবস্থায় পরিনত হয়েছে। ঠিক এমনই অতিরিক্ত অস্থায়ী শিল্প ও বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক মুনাফা ক্ষতি করছে চাষেরও।

কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট লগ্নির প্রয়োজনীয়তা, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ২০২০ সালের বাজেটেই ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু দীর্ঘ কৃষক আন্দোলনের কারণে তা বাতিল হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বারবার করে বোঝাতে চাইছে কর্পোরেট ও বৈদেশিক লগ্নি পড়ে যাওয়া কৃষি অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটাবে কিন্তু সরকারের এই কর্পোরেট বান্ধব প্রকল্পগুলির জন্য জলাবায়ু ও কৃষির যে ক্ষতি হচ্ছে তার দিকে সরকার কোনও দৃষ্টিপাতই করছে না। প্রতিদিন সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে চলছে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলন, ধর্নায় বসছেন পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ সহ অন্যান্য রাজ্যের কৃষকরা।

উত্তরপ্রদেশ জুড়ে উঠে আসছে একের পর এক কৃষক আত্মহত্যার খবর। নদীর বুকে বাঁধ বানিয়ে একের পর এক গ্রাম উজার হয়েছে ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’ ইতিহাসে নজির হয়ে থেকে যাবে আগামী কালেও। বাংলার সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রামের মতন পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলন সবসময়ই প্রতিরোধ এনেছে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে।

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
মতামত দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *